বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮-এর উপধারা(১)-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি
see more
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হত্যা, নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নসহ নানা অপরাধের দায়ে এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের দাবির মুখে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৭৬ বছরে পা দিয়েছে সংগঠনটি রাষ্ট্রপতির আদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ সংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ‘যেহেতু ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। এসব কারণে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে যে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।-২ এ ‘ এ কারণে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮-এর উপধারা(১)-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ আইনের তফশিলবাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হলো।সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮ (১)-এ বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোন ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।’ ধারা ১৮ (২)-এ বলা হয়েছে, ‘সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোন ব্যক্তি বা সত্তাকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে বা তফসিল হইতে বাদ দিতে পারিবে অথবা অন্য কোনভাবে তফসিল সংশোধন করিতে পারিবে।’
এই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোন ব্যক্তিকে ধারা ১৮ এর বিধান অনুসারে তালিকাভুক্ত করা হয় বা কোন সত্তাকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহা হইলে, এই আইনে বর্ণিত অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও সরকার, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, নিুবর্ণিত যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে, যথা:-(ক) উক্ত সত্তার কার্যালয়, যদি থাকে, বন্ধ করিয়া দিবে; (খ) ব্যাংক এবং অন্যান্য হিসাব, যদি থাকে, অবরুদ্ধ করিবে, এবং উহার সকল সম্পত্তি জব্দ বা আটক করিবে; (গ) নিষিদ্ধ সত্তার সদস্যদের দেশ ত্যাগে বাধা নিষেধ আরোপ করিবে; (ঘ) সকল প্রকার প্রচারপত্র, পোস্টার, ব্যানার অথবা মুদ্রিত, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্যান্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত করিবে; এবং (ঙ) নিষিদ্ধ সত্তা কর্তৃক বা উহার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোন প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ করিবে।’
বুধবার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এদিন নিজের ফেসবুকের এক পোস্টে রাতের মধ্যেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে বলে জানান তিনি।
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ৭২-এর মুজিববাদী সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে ছাত্রলীগকে আগামী একদিনের মধ্যে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। একই দাবি জানান জাতীয় নাগরিক কমিটিও। তাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবাদ সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানান হাসনাত আব্দুল্লাহ।
ছাত্রলীগের ইতিহাস : আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। যদিও আওয়ামী লীগের জন্ম হওয়ার এক বছর আগে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। সংগঠনটির প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। সাংগঠনিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান। পরবর্তীকালে এ সংগঠনের নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পর্যন্ত মোট ৩১টি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে দুটি আহ্বায়ক কমিটি করা হয় .কিন্তু বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তর্কোন্দল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। ধীরে ধীরে একটা লড়াকু ছাত্র সংগঠন আস্তে আস্তে তার চরিত্র বদলে একটা ‘ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল’ সংগঠনের দিকে যাত্রা শুরু করে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দেশের নানা এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে। বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের মতো অভিযোগ ছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একাধিক ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধর করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বেপরোয়াভাবে হামলা, নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
Post a Comment